শিল্পীপ্রেমী দর্শকদের মন জয় করলো আকাঙ্ক্ষার নবতম প্রযোজনা প্রিয়ম্বদার মৃত্যু
নীরেশ ভৌমিক : নাটক মানুষের হৃদয়ের কথা বলে, নাটক মানব মুক্তির কথা বলে । তরুণ তুর্কি নাট্যদল গোবরডাঙ্গা আকাঙ্ক্ষা নাট্য সংস্থার নবতম মঞ্চ সফল প্রযোজনা প্রিয়ম্বদার মৃত্যু। রচনা আতিকুর রহমান সুজন এবং নির্দেশনা দীপাঙ্ক দেবনাথ। গত ২০ শে আগস্ট চুঁচুড়া রবীন্দ্রভবন বাঁশবেড়িয়া মঞ্চ দর্পনের আমন্ত্রণে এবং ৬ ই সেপ্টেম্বর কলকাতা মুক্তাঙ্গনে টালিগঞ্জ বঙ্গীয় নাট্যাঙ্গনের আমন্ত্রণে সফলভাবে মঞ্চস্থ হলো প্রিয়ম্বদার মৃত্যু। এই নাটকটির মধ্য দিয়ে উঠে আসে একজন শিল্পীর জীবন যুদ্ধের কাহিনী। সুখ-দুঃখ প্রেম ভালোবাসা আবেগ সমস্ত কিছুর সংমিশ্রণেই তৈরী হয় একজন শিল্পীর মন।
তাঁর স্ত্রী প্রিয়ম্বদা নিজেও একজন শিল্পী। শিল্প এবং শিল্পী কে ভালোবেসে তাদের ভালোবাসা পরিপূর্ণতা পায়। নাটকে ফুটে উঠেছে সাংসারিক অভাব অনতন কিন্তু তার মধ্যেও খুশি, মজা এবং স্ত্রী সন্তানের সাথে খুনসুটির কাহিনী ও তৈরি করেছে সুন্দর মুহূর্ত। সারাদিন তিনি মজে থাকেন গানবাজনা নাটকের মধ্যে। সংসারের দিকে,স্ত্রী, সন্তানের দিকে কোনো ই নজর নেই তাঁর,শিল্পের জন্য তিনি পাগল। তাঁদের কোনো মতে নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। শিল্প চর্চায় কোনো প্রকার খামতি রাখেনি তিনি।
ঘরে অসুস্থ ছেলে ডাক্তার দেখানোর ও টাকা নেই। দিনের পর দিন ধরে বাড়িতে অশান্তি। তিনি টাকা ধার করে সংসার চালান এবং তাঁর স্ত্রীর গয়না বন্দক দিয়ে নাটকের উৎসব করেন, যে গয়না হয়তো আর কোনোদিন ই ফিরে পাবেনা তাঁর স্ত্রী । বাড়ির উপর দিনের পর দিন এসে টাকা চায় সুদখোর। প্রিয়ম্বদার প্রতি কুদৃষ্টি সুদখোরের কিন্তু সে কথা জানাতে পারেন না তাঁর স্বামী। পুরুষ চান মুক্ত প্রকৃতির মাঝে ভেসে বেড়াতে, শিল্পের প্রতি এক প্রাণ শক্তি নিয়ে বাঁচতে চায় তিনি। শিল্পের জন্য পাগলামি দিনদিন বাড়তেই থেকে।
একদিন প্রবল ঝড় বাদলের রাতে বাচ্চাটির শরীর প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে পরে। বাইরে প্রবল ঝড় সঙ্গে বিদ্যুতের ঝালকানি। বাড়িতে ঝামেলা করে বেড়িয়ে গ্যাছেন তিনি । বাচ্চাটিকে সামলাতে পারছেনা তার মা। বাড়ি ফিরেই যখন দেখল বাচ্চাটির শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটেছে বাবা হয়ে বাচ্চাটির মুখের দিকে তাকিয়ে তাঁর মা কে কোলের সন্তান ফিরিয়ে দিতে বুকে পাথর চাপা দিয়ে হারমোনিয়াম বিক্রি করে বাচ্চার চিকিৎসা করানোর সিন্ধান্ত নেয় তিনি। শেষ সময় বাচ্চার জন্য শিল্পকে বিক্রি করতেও একবারও ভাবেননি তিনি। সমাজে পিছিয়ে পরা দুর্বল শ্রেণীর ওপর চলে সবসময় অত্যাচার।
সমাজের একশ্রেণীর পুরুষ চায় নারীদের ভোগ করতে আর সেই নারী যদি হয় অসহায় তো সুযোগ আরো বেশী। তাঁর স্বামী ঘরে না থাকার সুযোগে সেই সুদখোর তাঁর বাড়িতে এসে প্রিয়ম্বদার নারীত্ব কে নষ্ট করে সন্তানের সামনে। বাচ্চাটির আত্মনাদ, প্রবল জ্বর, শ্বাসকষ্ট নিয়ে মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে । চোখের সামনে দেখলো তাঁর মায়ের উপর অমানবিক অত্যাচার। শিশুটি প্রচন্ড ভয়ে এবং শারীরিক কষ্টে একটা সময় সে বিনা চিকিৎসায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারাযায়। অর্ধ উলঙ্গ বিদ্ধস্ত অবস্থায় সন্তানের কাছে ছুটে এসে মা যখন তাঁর জীবনের পরম সম্পদ কে হারিয়ে ফেলার যন্ত্রনা সহ্য করতে পারেনা তখন তিনি উম্মাদ হয়ে ওঠেন। প্রিয়ম্বদা নিজেও একজন থিয়েটার কর্মী। আজ সে ভুলে গ্যাছে তাঁর স্বামী ও শিল্প কে।
দশ মাস দশ দিনের প্রসব যন্ত্রণা সহ্য করে সেই নাড়ি ছেড়া ধন যখন মায়ের কোল ছেড়ে অনেক দূরে চলে যায় কোনো মা তা সহ্য করতে পারেনা। শেষ সময়ে যখন টাকা নিয়ে বাচ্চাটির বাবা বাড়িতে ফিরলো নিস্তব্ধ পরিবেশ কিছু বোঝার আগেই হারালো তাঁর স্ত্রী কেও। স্বামীর প্রতি রাগে , লজ্জায়, ঘৃণায় বাধ্য হলো গলায় দড়ি দিতে। প্রিয়ম্বদা ও তুনু কে হারিয়ে সে নিঃস্ব। স্বপ্নের গরিমায় অবদ্ধ করে তাঁর সন্তান তাঁর চোখে বেঁধে দেয় কালো কাপড়। তাকে তাঁর শিল্প জগৎ থেকে সরিয়ে এনে এক বেরাজালে আবদ্ধ করে শিশুটি। প্রিয়ম্বদা চোখের বাঁধন খুলে আবারো তার হাতে তুলে দেয় শিল্প। নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখায় তাকে শিল্পের মধ্যেই হলে তার পুনর্জন্ম । তিনি বিশ্বাস করেন একদিন এই শিল্প চর্চার মধ্যে দিয়েই জয়গান শুনবে সমগ্র শিল্পী মনন। শিল্পের জন্য শিল্পী শুধু এছাড়া নেই যে তার অন্য জীবন, মান্না বাবুর এই গানটি এক্ষেত্রে সার্থক।
নাটকটির মঞ্চপরিকল্পনায় ত্রিদীপ চক্রবর্তী, রূপসজ্জায় তনুশ্রী দেবনাথ দত্ত, আবহ পরিকল্পনাও প্রেক্ষাপন অঙ্কিতা সাধু , আলোক পরিকল্পনা ও প্রেক্ষাপন সুজয় পাল, অভিনয়ে অতনু রায়, কেয়া ঘোষ, অরণ্য সরকার,ত্রিদীপ চক্রবর্তী, অর্পিতা রায়, অঙ্কিতা সাধু, সাগর চক্রবর্তী ও দীপাঙ্ক দেবনাথ।নাটকটি নাট্যপ্রেমী মানুষের এবং দর্শকদের মনে এক বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে। পরিচালক দীপাঙ্ক দেবনাথ জানান, ” আগামী ১৭ও ১৮ ই সেপ্টেম্বর আমরা থাকছি আবারো রাজস্থানের মাটি তে প্রিয়ম্বাদার মৃত্যু ও আরো একটি নতুন প্রযোজনা রক্তের ডেলা নিয়ে। সকলের ভালোবাসা এবং আশীর্বাদে আকাঙ্ক্ষার কাঙ্খিত আকাঙ্ক্ষা পূরণ হোক। “