জেলার খবরসর্ম্বধনাসাহিত্য ও সংস্কৃতি।

অনুষ্ঠিত হল গণবিজ্ঞান আন্দোলনের কর্মী, লেখক শিক্ষিকা রেখা দাঁ (পাল) এর স্মরণ সভা

নীরেশ ভৌমিক : গণবিজ্ঞান আন্দোলনের কর্মী, লেখক শিক্ষিকা রেখা দাঁ (পাল) এর স্মরণ সভা অনুষ্ঠিত হলো গত ২৮ জুলাই ২০২৪ গোবরডাঙ্গা রেনেসাঁ ইনস্টিটিউট মঞ্চে। স্মরণ সভায় বহু সমাজকর্মী, লেখক বিজ্ঞানকর্মী, গবেষক উপস্থিত ছিলেন। উল্লেখ্য – রেখা দাঁ-এর মৃত্যু পর তাঁর চক্ষু ও দেহদান করা হয়। তাঁর সন্তান পরিবার মৃত্যু পরবর্তী কোন আচার, শ্রাদ্ধ তথা কোন ক্রিয়াদি পালন করেননি। কারণ রেখা দাঁ ও তার তাঁর পরিবার এসব মানতেন না বা বিশ্বাস করতেন না। রেখা দাঁ ও স্বামী দীপক দাঁ তাদের বাড়িতেই গড়ে তুলেছেন গোবরডাঙ্গা গবেষণা পরিষৎ। ২০১৫ সাল থেকে তিনি জটিল স্নায়বিক রোগে আক্রান্ত হতে শুরু করেন।

শুরুতে স্মৃতিভ্রংশ রোগে আক্রান্ত থেকে গত ৫ জুলাই, ২০২৪, শুক্রবার, দুপুর ২.২৫ মিনিট নাগাদ ৭২ বছর বয়স রেখা দাঁ শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার পাশাপাশি জনবিজ্ঞান আন্দোলন, বিজ্ঞান ক্লাব আন্দোলন, প্রকৃতি-পরিবেশ-জীববৈচিত্র্য রক্ষার আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ ও অন্যান্য ধারার রচনায় তাঁর সহজাত দক্ষতা ছিল। নানাবিধ সামাজিক কাজকর্মে তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করতেন।লেখালিখির ব্যাপারে তাঁর সহজাত আগ্রহ ছিল।

মূলত বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ লিখতেন, জনবোধ্য (popular) বিজ্ঞানের নানা শাখায় ছিল তাঁর স্বচ্ছন্দ বিচরণ। প্রাণিবিদ্যা বিষয়ে ফিচারধর্মী কিছু মূল্যবান রচনাও রয়েছে। শিক্ষাব্যবস্থা, সমাজভাবনা বিষয়ে কম হলেও কিছু তাত্ত্বিক নিবন্ধ লিখেছেন। স্বল্প পরিচিত বিস্মিতপ্রায় বাঙলি বিজ্ঞানীদের নিয়ে তাঁর লেখা বই ‘বিজ্ঞান সাধনায় বাঙালি ও অন্যান্য রচনা’ প্রকাশিত হয় ২০১৭ সালে জ্ঞানবিচিত্রা প্রকাশনী থেকে। বইটি উচ্চ প্রশংসিত হয়।

তাঁর প্রথম বই ‘উইপোকা’ প্রকাশিত হয় ২০০০ সালে (প্রকাশক-জ্ঞানবিচিত্রা) আকাশবাণী বিজ্ঞান বিভাগে (কলকাতাতে) তিনি একাধিকবার বিজ্ঞান কথিকা পাঠ করেছিলেন। মায়ের বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ ও ফিচারধর্মী লেখালিখি গোবরডাঙা পত্রিকা, কুশদহ বার্তা, গ্রামবাংলা পত্রিকা, কিশোর জ্ঞানবিজ্ঞান, এযুগের কিশোর বিজ্ঞানী, জ্ঞানবিচিত্রা, জ্ঞান ও বিজ্ঞান, বিজ্ঞান অন্বেষক, বিজ্ঞানমেলা, এবং কে কি ও কেন, কালান্তর দৈনিকের ‘প্রকৃতি ও মানুষ’ পাতায়, বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত মাসিক বিজ্ঞান সাময়িকী, অণু পত্রিকাতে নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হয়েছে প্রায় ২০১২-১৩ সাল পর্যন্ত।

তাঁর গদ্য ছিল সহজ ও ঝরঝরে, স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। সর্বদাই অধ্যবসায়ী প্রয়াসে তথ্য সংগ্রহ করে তিনি নিবন্ধ নির্মাণ করতেন। সংবাদপত্রের পেপার কাটিং করে সংরক্ষণ করতেন মনোযোগ সহকারে। বৃহত্তর গোবরডাঙা অঞ্চলে তিনিই প্রথম মহিলা বিজ্ঞান লেখিকা। ১৯৯৯ সালে মাসিক বিজ্ঞান সাময়িকী পত্রিকার ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে বিশেষ জয়ন্তী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য ঢাকা, বাংলাদেশ থেকে তাঁকে আমন্ত্রণ পত্র পাঠিয়েছিলেন পত্রিকার সম্পাদক, পদার্থবিজ্ঞানী ড. মুহাম্মদ ইব্রাহিম (নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী মুহম্মদ ইউনুস-এর ভাই)।

রবীন্দ্র পুরস্কারপ্রাপ্ত বিজ্ঞান লেখক ড. মৃত্যুঞ্জয়প্রসাদ গুহের সম্পাদিত বইতে তাঁর উদ্ভিদবিজ্ঞান বিষয়ক লেখা ও আঁকা ছবি প্রকাশিত হয়েছিল। বিজ্ঞান প্রচারক বা জনবিজ্ঞান সংগঠক হিসাবে বিজ্ঞান আন্দোলনের অগ্রণী যোদ্ধা দীপক দাঁ যে উচ্চতায় উন্নীত হয়েছেন তার নেপথ্যে রেখা দাঁ-এর আত্মত্যাগ, অবদান অনস্বীকার্য। আবার ছেলেমেয়ের পড়াশুনা কিসে আরও ভালো হবে, কোন গৃহশিক্ষকের কাছে পড়তে হবে, পাঠ্য বইয়ের বাইরে কী কী রেফারেন্স বই সংগ্রহ করতে হবে, কিভাবে নোট তৈরি করতে হবে, সে ব্যাপারে তিনি সদা তৎপর ছিলেন। তাদের সফল ক্যারিয়ারের প্রধান স্থপতি ছিলেন তাদের মা। নিজে অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতেন, সন্তানদেরও সেই শৃঙ্খলা ও আদর্শে বড়ো করেছেন।

তাঁর কাছে একটা হোমিওপ্যাথি ঔষধের বাক্সে দরকারি ঔষধ সবসময় রাখা থাকত। দাঁ-বাড়ির সদস্যরা, পাড়া প্রতিবেশীরাও তা থেকে উপকৃত হতেন। সকল অর্থেই তিনি ছিলেন একজন সামাজিক মানুষ। তাঁর মধ্যে বহু মানবিক সদগুণের সমন্বয় লক্ষ্যণীয় ছিল। সেবার মন ছিল তাঁর, অন্যের সমস্যায় বিচলিত হয়ে তাদের সাহায্য করতে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। বহুমানুষ আজও কৃতজ্ঞতায় তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাশীল। সম্প্রতি তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে গোবরডাঙা রেনেসাঁস ইনস্টিটিউটে মুক্তমঞ্চের সামনে তাঁর Friend-Philosopher-Guide কল্যাণী দাশগুপ্তার সম্মানে একটি স্মারক মঞ্চগৃহ নির্মাণ করা হয়েছে। এর ফলে এখানে আলোচনাচক্র ও অন্যান্য অনুষ্ঠান সুন্দরভাবে রূপায়িত করা যাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *